ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাসে প্রাচীন পণ্ডিতদের মধ্যে একাধারে শিক্ষক, দার্শনিক এবং কূটনীতিবিদ হিসেবে চাণক্য আজও অমর হয়ে আছেন। তিনি কৌটিল্য বা বিষ্ণুগুপ্ত নামেও পরিচিত ছিলেন। আধুনিক ভারতের রাষ্ট্রবিজ্ঞান ও অর্থনীতির জনক ছিলেন চাণক্য। এমনকি তাঁর লেখা ‘অর্থশাস্ত্র’ বইটি ভারতের প্রথম রাজনৈতিক গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও তার পুত্র বিন্দুসারের একনিষ্ঠ পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করলেও রহস্যজনকভাবেই তাঁর মৃত্যু হয়। কুচক্রীদের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে কীভাবে চাণক্য মারা গেলেন তা আজও এক অমীমাংসিত অধ্যায়। ভারতের ইতিহাসে তাই চাণক্য মৃত্যু রহস্য (Chanakya Death Mystery) আজও চর্চার বিষয়।

মৌর্য বংশীয় রাজা প্রথম চন্দ্রগুপ্তের উত্থান এবং নন্দ সাম্রাজ্যের পতনের জন্য চাণক্যের কূটবুদ্ধির প্রয়োগ সমগ্র বিশ্বের কাছে একটি চর্চার বিষয়। অর্থশাস্ত্রের মধ্যে থাকা রাষ্ট্র পরিচালনা সংক্রান্ত চাণক্যের নীতিগুলি আজও দক্ষ রাষ্ট্রনেতাদের দ্বারা সমাদৃত হয়। খ্রিস্টপূর্ব ৩৭৫ অব্দে তক্ষশীলা নগরে এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ পরিবারে চাণক্যের জন্ম হয়েছিল। ছোটবেলা থেকেই তাঁর মধ্যে একজন দক্ষ প্রশাসকের স্বভাব-বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যেত। বন্ধুদের নিয়ে রাজসভা রচনা, যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা, আত্মগোপনের কৌশল ইত্যাদি অনুশীলন করতেন তিনি। পরে তক্ষশীলা মহাবিহারে পড়াশোনা করে মহাপণ্ডিত হয়ে ওঠেন চাণক্য। তক্ষশীলায় পরে শিক্ষকতাও করেছেন তিনি। তিনিই নন্দবংশীয় অত্যাচারী রাজা ধননন্দকে পরাজিত করে চন্দ্রগুপ্তকে মগধের রাজসিংহাসনে বসতে সাহায্য করেন এবং ধননন্দের কন্যা দুর্ধার সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের বিবাহ দিয়ে নিজের কূটনৈতিক বুদ্ধির পরিচয় দেন চাণক্য। আলেকজান্ডার ভারত আক্রমণ করলে পাঞ্জাব প্রদেশের সীমানায় তাঁদের শিবিরে গিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে গোপনে যুদ্ধনীতি শিখতে পাঠিয়েছিলেন চাণক্য। তারও পরে পরাজিত ধননন্দের মন্ত্রী ও অন্যান্য পারিষদবর্গ চন্দ্রগুপ্তকে আক্রমণ করলে গুপ্তচরের সাহায্যে আগাম সংবাদ পেয়ে চাণক্যের সহায়তায় চন্দ্রগুপ্ত তাদের পরিকল্পনা ব্যর্থ করে দেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পুত্র বিন্দুসারের মুখ্য রাজনৈতিক উপদেষ্টা ছিলেন চাণক্য। কিন্তু তা সত্ত্বেও কোন গভীর চক্রান্তের ফলে চাণক্যের মৃত্যু হল?
চাণক্য মৃত্যু রহস্য নিয়ে দুটি মত প্রচলিত। প্রথম মতানুসারে বলা হয় যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালের শেষে চাণক্য রাজকার্যের প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে জঙ্গলে চলে যান। সেই জঙ্গলেই কিছুদিন সময় কাটান তিনি এবং ধীরে ধীরে উপবাসের কারণে তাঁর মৃত্যু হয়। আবার দ্বিতীয় মতানুসারে বলা হয় রাজা বিন্দুসারের কুচক্রী মন্ত্রী সুবন্ধুর চক্রান্তেই তাঁর মৃত্যু হয়। চন্দ্রগুপ্ত দীর্ঘ ২৪ বছরের প্রজাকল্যাণমুখী রাজ্য শাসনের উপান্তে এসে আচার্য চাণক্যের কাছে এসে রাজকার্য থেকে মুক্তি চান। স্বেচ্ছা-মৃত্যুর ইচ্ছা নিয়ে রাজ্য থেকে বহু দূরে চলে যান চন্দ্রগুপ্ত। জৈনদের কাহিনি অনুসারে সেখানে উপবাসে কাটিয়েই বেশ কিছু দিন পরে চন্দ্রগুপ্তের মৃত্যু হয় আর প্রিয় শিষ্যের মৃত্যুর ফলে অবসন্ন শোকাকুল চাণক্য চাইলেন আরেক শিষ্য রাধাগুপ্তকে বিন্দুসারের প্রধানমন্ত্রীর পদে অভিষিক্ত করে চাণক্য নিজে রাজকার্য থেকে অব্যাহতি নেবেন। রাজা বিন্দুসারের কাছে এ বিষয়ে আর্জি জানানোর আগেই রাধাগুপ্ত চাণক্যকে জানান যে মন্ত্রী সুবন্ধু বিন্দুসারের কান ভাঙিয়ে তাঁকে বিশ্বাস করাতে চাইছেন যে জন্মের সময় তাঁর মাকে চাণক্যই বিষ খাইয়ে হত্যা করেছেন। ক্ষমতালোভী এবং ঈর্ষাপরায়ণ মন্ত্রী সুবন্ধুর পরিকল্পনা বুঝতে চাণক্যের আর দেরি হল না। কিন্তু এই সংবাদে একটুও বিচলিত না হয়ে শিষ্য রাধাগুপ্তকে নিজের স্বেচ্ছা-মৃত্যুর বেদী রচনা করতে নির্দেশ দেন চাণক্য। ইতিমধ্যে বিন্দুসার যখন চাণক্যকে যোগ্য শাস্তি দেওয়ার জন্য ডেকে পাঠান তখনই এক পরিচারিকা এসে বিন্দুসারকে সবিস্তারে আসল সত্য ঘটনা সম্পর্কে অবগত করেন। সেই পরিচারিকার মুখ থেকেই বিন্দুসার জানতে পারেন যে, রাজা চন্দ্রগুপ্তের জীবৎকালে চাণক্য তাঁকে পরিকল্পনামাফিক প্রতিদিন খাবারের সঙ্গে সামান্য পরিমাণ বিষ মিশিয়ে দিতেন। চন্দ্রগুপ্তের শত্রুর অভাব ছিল না। ফলে দুরদৃষ্টিসম্পন্ন চাণক্য বুঝতে পেরেছিলেন চন্দ্রগুপ্তকে যে কেউ যে কোনও সময় খাবারে বিষ মিশিয়ে হত্যার পরিকল্পনা করতে পারেন আর তাই আয়ুর্বেদশাস্ত্র মতে অল্প অল্প করে আগে থেকেই বিষ প্রয়োগ করে চন্দ্রগুপ্তের শরীরকে বিষ-প্রতিরোধী করে তুলতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু এরই মাঝে একদিন চন্দ্রগুপ্তের সন্তানসম্ভবা দ্বিতীয়া স্ত্রী দুর্ধা চন্দ্রগুপ্তের জন্য পরিবেশিত খাবার ভাগ করে নিজে খেয়ে ফেলেন। আর কিছুদিনের মধ্যেই দুর্ধার সন্তানের জন্ম হত। ঠিক সেই মুহূর্তেই সামান্য পরিমাণ বিষের প্রতিক্রিয়ায় মুমূর্ষু হয়ে পড়েন তিনি। খবর পেয়ে চাণক্য ছুটে আসেন, কিন্তু কোনওভাবেই দুর্ধাকে বাঁচিয়ে তোলার সম্ভাবনা দেখতে না পেয়ে সত্বর ছুরি দিয়ে দুর্ধার পেট কেটে গর্ভস্থ পুত্র বিন্দুসারকে ভূমিষ্ঠ করান। বিষক্রিয়ার কারণে দুর্ধা মারা যান, কিন্তু চন্দ্রগুপ্তের বংশ অক্ষত রাখতে চাণক্যের কাছে বিন্দুসারের জন্ম হওয়াটাই বেশি প্রাধান্য পেয়েছিল। কিন্তু মাতৃগর্ভের মধ্যেই বিষ বিন্দুসারের কপালে স্পর্শ করায় তার কপালে নীল একটি বিন্দু দেখা দেয়, সেই কারণেই তাঁর নাম রাখা হয়েছিল বিন্দুসার।
এই ঘটনা শুনে অত্যন্ত অনুতপ্ত হন বিন্দুসার এবং চাণক্যকে স্বেচ্ছামৃত্যু থেকে বিরত রাখতে তিনি বেরিয়ে পড়েন রাজপথে। ততক্ষণে বিন্দুসার সংবাদ পেয়েছেন যে নিজের সমস্ত ধন-সম্পদ গরীব-দুঃখীদের বিলিয়ে দিয়েছেন চাণক্য এবং স্বেচ্ছামৃত্যুর বেদীতে ধ্যানমগ্ন হয়েছেন তিনি। এই সংবাদ পেয়ে মন্ত্রী কুচক্রী সুবন্ধুকে তিনি নির্দেশ দেন তিনি যেন সত্বর চাণক্যের কাছে গিয়ে তাঁকে বিরত করেন। সুবন্ধু এই সুযোগে চাণক্যের বেদীর ভিতরে প্রচুর পরিমাণ ঘুঁটে রেখে দেন এবং বিন্দুসার আসা মাত্র চাণক্যকে প্রণাম করার ছলে সেই ঢিপিতে আগুন লাগিয়ে দেন। দাহ্য ঘুঁটে থাকায় সহজেই চাণক্যের ধ্যানের বেদী অগ্নিদগ্ধ হয়ে যায়। আর সেই আগুনে পুড়ে মারা যান চাণক্য। বিন্দুসার তাঁকে উদ্ধার করে আনলেও আগুনে ততক্ষণে ঝলসে গিয়েছে তাঁর শরীর।