দ্যা আটোম্যান সেঞ্চুরিস পর্ব ৮
খ্রিস্টানদের সহনশীলতার ফলে এটি মুসলিম রাষ্ট্র হিসেবেই রয়ে যায়
যেটির জাতীয়তার বীজ নিহিত ছিল ধর্মে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের পরও মুসলিম
এবং খ্রিস্টানদের মাঝে পার্থক্যও বজায় ছিল। মৌলিকভাবে এটি ছিল জমি ও
এর ভাগ-বাটোয়ারা নিয়ে ।
মুসলিমরা বাধ্য ছিল সামরিক দায়িতু পালনে।
ফলে তারাই জমির স্বত্বাধিকারীর উপযুক্ত ছিল। দায়িত্ব পালনে পুরস্কারস্বরূপ
এটি বন্টন করা হতো । এর ফলে সৈন্য নিয়োগের উৎস হিসেবে ও কাজ করত
জমি, কেননা এতে কর দিতে হতো না। খ্রিস্টানরা সামরিক কাজে অংশগ্রহণ
করতে পারত না, তাই কোন রূপ জমির মালিকানার সুবিধাও পেত না। বরঞ্চ
তারা সামরিক বাহিনীর জন্য মাথাপিছু কর দিত।
এ কারণে পদমর্যাদার ক্ষেত্রে
তারা মুসলিমদের চেয়ে নিচু স্তরে ছিল। গ্রাম্য জেলাগুলোতে এ প্রবণতা ছিল
বেশি। তাই খ্রিস্টানরা শহরে বাস করতে চাইত । যেখানে এ বৈষম্য অন্যান্য
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের সুবাদে অনেকটাই দূর হতো । কিন্তু স্বেচ্ছায় ইসলামে
দীক্ষিত হলে সেই খ্রিস্টান রাতারাতি ওসমান অনুসারী বনে যেত। এতে করে
তার পূর্ব ইতিহাসও সহজে ভুলে যাওয়া হতোও করমুক্ত জীবন-যাপন করত।
জমি অধিগ্রহণ করতে পারত, উন্নঘনের সুযোগ পেত এবং মুসলিম
শাসকগোষ্ঠীর মাঝে জায়গা পেত। অটোমান ইতিহাসে এ পর্যায়ে এসে
এশিয়াতে মুসলিম দীক্ষিতের সংখ্যা বেড়ে যায়।
৩০
সামন্তপ্রথা হলেও এই অটোমানীয় সামরিক জায়গির প্রথা ইউরোপে
প্রচলিত সামভ্তপ্রথার তুলনায় ভিন্ন ছিল। এক্ষেত্রে জমির পরিমাণ ছিল কম
এবং সবার ওপরে ছিল দৈবাৎ উত্তরাধিকার। কেননা সব জমিই ছিল রাষ্ট্রের
সম্পত্তি! এভাবে অংশ এসে জমি দিয়ে কোনোরূপ মহত্ব বিবেচিত হতো না,
যেমনটা ছিল ইউরোপের জমিদার অভিভাবকরা । বিজয়ী অঞ্চলের ওপর
সুলতানেরই শুধু একচ্ছত্র আধিপত্য বজায় ছিল।
এছাড়া তারা যত বিজয়ীহচ্ছিলেন সৈন্যরা ততই পুরস্কারস্বরূপ জমির মালিক হয়ে যায়। এ জাতীয়
ব্যবস্থা কাঠামোতে অর্খান, বড় ভাই আলা-এদ-দিনের পরামর্শ অনুযায়ী
নিয়মিত সেনাবাহিনী প্রস্তুত করেন সার্বভৌম অধিকার বলে, পেশাদার সামরিক
শক্তি যুদ্ধ করার ক্ষেত্রে চির প্রস্তুত রূপে। এটি এমন একটি ব্যবস্থা যা
ইউরোপে পরবর্তী দুই-শতাব্দীতেও অনুকরণ করা হয়নি।
অর্থানের পিতা ওসমানের সেনাবাহিনীতে শুধু ছিল অনিয়মিত তুর্কমানরা,
স্বেচ্ছাসেবক, যাদের নাম ছিল একিনজিস, যাদের নিয়োগ দেয়া
হতো গ্রামে গ্রামে মুখের ভাষায় শমন জারির মাধ্যমে একটি নির্দিষ্ট দিনে।
ভাষা ছিল “যারা যুদ্ধ করতে চায়।”
তারা ছিল দক্ষ ঘোড়সওয়ার, চলাচল করত একত্রে, যেন একটি দেয়াল। অর্খান এদেরকে নিয়োগ দিতেন। সামরিক
জায়গিরদারদের মাঝে থেকে এদেরকে প্রস্তুত করা হতো অশ্বরোহী সৈন্যদল
হিসেবে, যাদের কাজ ছিল কোনো নির্দিষ্ট আক্রমণের পূর্বে দেশটিকে উন্মুক্ত
করা। এভাবেই সৈন্যদের বিশ্বস্ততা জমির পরিমাণে নিশ্চিত হতো । এদেরকে
সহায়তা করত নিয়মিত বেতনভুক্ত অশ্বারোহী সৈন্যদল সিপাহিরা এবং চাভূস
নামধারী গাইডেরা |
এছাড়াও অর্থান অনিয়মিত একটি বাহিনী প্রস্তুত করতেন, নাম ছিল
আজাব | যাদের অবস্থান থাকত সম্মুখে যারা যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর ওপর
প্রথম আঘাত হানত। এদের পেছনে শক্ররা আশ্চর্য হয়ে মুখোমুখি হতো
সাবধানতার সাথে বাছাই করা সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর । বেতনভুক্ত সৈন্যরা
একত্রে যুদ্ধ করার প্রশিক্ষণ পেত। তাদের নেতাকে তারা মান্য করত, যিনি
তাদের পরিচিত ও সম্মানীয় ছিলেন।
এই সময়কার প্রচলিত অন্যান্য ভাড়াটে
সৈনিকদের তুলনায় অর্খানের সৈন্যরা নিজেদের সার্বভৌমত্বের কাছে
উৎসগীকৃত ছিল। তাকে মান্য করত আর বিশ্বাস করত যে এভাবেই তাদের
পদোন্নতি ও অন্যান্য উদ্দেশ্যে সুরক্ষিত থাকবে । মৌলিকভাবে তারা সময়
“সুলতানের তাবুর দরজায়” থাকত। তারা সুলতানের একচ্ছত্র আধিপত্য
মেনে নিয়ে ব্যক্তিগত বা সমষ্টিগতভাবে তার আজ্ঞা পালন করত সেনানায়কের
আদেশানুযারী ৷ এই নতুন নিয়মিত অটোমান সেনাবাহিনীর প্রধান শক্তিই ছিল
তাদের এক্য। এছাড়া আরেকটি শক্তি ছিল যুদ্ধের জন্য সবসময় প্রস্তুত থাকা ।
যেত না। তাদের সেনাবাহিনীতে ছিল প্রথম শ্রেণীর গোয়েন্দা ব্যবস্থা । শত্রু
কখন এবং কোথা দিয়ে আসবে তা নিয়ে নিশ্চিত খবর থাকত তাদের হাতে।
এছাড়াও ছিল দক্ষ গাইডেরা। যারা তাদের সৈন্যদের পথ দেখাত। একজন
ভ্রমণকারী ব্রার্্রীভ দে ব্রোকুইরে এসব অটোমান সৈন্য সম্পর্কে লিখে গেছেন :
তারা হঠাৎই শুরু করতে পারত। আর মাত্র একশ খ্রিস্টান যোদ্ধাও দশ
হাজার ওসমান অনুসারীর চেয়ে বেশি শব্দ করতে পারত। ড্রাম বেজে ওঠার
সাথে সাথে তারা চলা শুরু করত আর আদেশ না আসা পর্যন্ত থাকত না।
হালকা অস্ত্রে সঙ্জিত হয়ে এক রাতে তারা এতটাই পথ চলতে পারত যা!
তাদের খ্রিস্টান শক্ররা তিন দিনে পার হতো ।
শত বছরের যাযাবর জীবনের অভ্যাস, দ্রন্তগতি আর এক স্থান থেকে
আরেক স্থানে ভ্রমণের অভ্যাসের ফলে এভাবেই গড়ে উঠেছিল একটি সামরিক
জাতি; যারা ছিল পরিশ্রমী, সুশৃঙ্খল আর একরোখা। একই কথা বলা যায়
প্রতিষ্ঠান এবং কৌশলের ক্ষেত্রেও, যা যুদ্ধের প্রধান নীতি। এভাবেই অটোমান
রাষ্ট্রের নিয়তি নির্ধারিত হয়েছিল সাম্রাজ্যের দিকে ।
এক্ষেত্রে এ জনগোষ্ঠীর যাযাবর জীবনের অভ্যাস ক্রমেই সামনের দিকে যাওয়া, নতুন তৃণভূমির
সন্ধানে, কাজ করেছিল। ইসলামে ধর্মীভ্তরিত হবার সাথে সাথে এই যাত্রা
আরো বেগবান হয়ে এবং গাজী হিসেবে ধর্মীয় দায়িতৃ পালন মুখ্য হয়ে ওঠে।
এভাবেই তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে পবিত্র আইনের ভিত্তিতে অবিশ্বাসীদের
বিরুদ্ধে । এগিয়ে যায় দার-নাল হারবের জমি দখল করার জন্যে। সম্পত্তি
দখল করে, হত্যা অথবা বন্দি করে এর জনগণকে এবং সবকিছুকেই মুসলিম
শাসনাধীনে নিয়ে আসে।
এক্ষেত্রে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক তাগিদ ও ছিল।
কেননা জনসংখ্যা ক্রমেই বেড়ে যাচ্ছিল। অন্যান্য শরণার্থীরাও ছিল। যেমন
যাযাবর, গোড়া নয় এমন মুসলিম অথবা মূল আনাতোলিয়া থেকে আগত
অভিযাত্রী । সুতরাং মধ্য এশিয়ার অনুর্বর ভূমি থেকে বের হয়ে এসব তুর্কিকে
এখন মোকাবেলা করতে হবে অপরিচিত এবং রুক্ষ এক পরিবেশের- সমুদ্র ।
চতুর্দশ শতাব্দীর মধ্যভাগে এসে তাদের সৈন্যরা প্রস্তুত হয় ইউরোপে যাত্রার
জন্য।
এশিয়াজুড়ে মঙ্গোলদের আগমণের মতো ইউরোপে তুর্কিদের প্রবেশ কোনো
হঠাৎ আক্রমণ নয়। ধীরে ধীরে ক্রমানুসারে এর ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়েছিল যার
ক্ষেত্রে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের ভাগ্যকাশ ভেঙে পড়া এবং পতন একটি বড়
ভূমিকা রেখেছিল। বিভিন্ন অনৈক্য এক্ষেত্রে ভূমিকা রেখেছিল ।