ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
ক্ষমতা এসে কেন্দ্রীভূত হয় গাজীদের হাতে । বাইজেন্টাইন প্রতিরক্ষা
ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে। নতুন নতুন অঞ্চল আর লুষ্ঠনের জন্য, এমনকি
্রাতৃপ্রতিম শত্রু আকরিতাই রাও গাজীদের বাধা দিতে পারেনি ।
টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া অরক্ষিত গ্রিক শক্তির কাছ থেকেও কোনোরূপ বাধা
ছাড়াই গাজীরা পশ্চিম এশিয়া মাইনরে ছড়িয়ে পড়ে।
আর এ সমস্ত অঞ্লের
ভাগ বাটোয়ারা করতে গিয়ে গোত্রপ্রধানরা নিজেদের মাঝে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে।
এ ক্ষেত্রে এ প্রধানরা হয়ে ওঠে মোটামুটিভাবে গাজী মতবাদের ধারক এবং
বাহক । এদের মাঝে অন্যতম ছিল ওসমানীয় মতবাদ পরবর্তীতে যা অটোমান সাম্রাজ্য হিসেবে অন্যতম বিশ্ব শক্তিতে
পরিণত হয়। এর ফলে বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের শূন্যস্থান পূর্ণ হয় আর এর
অধীনে শাসিত হয় পরবর্তী ছয়টি শতাব্দী ।
অধ্যায় এক
সাম্রাজ্যের সূর্যোদয়
অটোমান রাজবংশের প্রথম দিকটার ইতিহাস ঢেকে আছে বিভিন্ন পৌরাণিক
কল্পকাহিনীতে । এ সম্পর্কে বিভিন্ন মতও প্রচলিত আছে। এঁতিহাসিকভাবে এর
প্রতিষ্ঠাতা আর্তঘরুল নামে একজন গোত্রপ্রধান। এশিয়া মাইনরে অভিবাসনের
সময় তিনি মাত্র চারশ ঘোড়সওয়ার সাথে করে নিয়ে আসেন। পথিমধ্যে দুই
অজানা দলের মাঝে বিবদমান যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েন। কিন্তু অজানা হলেও
করেন। এর ফলে তারা জয়লাভ করে।
পরবর্তীতে জানা যায়__এই দলটি ছিল
সেলজুক, রাষ্ট্র কন্যার সুলতান আলা-এদ-দিন এর বাহিনী । যারা মঙ্গেলদের
বিরুদ্ধে লড়ছিল। এর ফলে খুশি হয়ে আল-এদ-দিন আনাতোলিয়ার পশ্চিমে
সুগতে শ্রীন্ম আর শীতের বসবাসের উপযোগী জমি পুরস্কার দেন
আর্তঘারুলকে। এর পরিপ্রেক্ষিতে আর্তঘরুল সুলতানকে আরেকটি যুদ্ধে জয়ী
হতে সহায়তা করে। এই পর্যায়ে যুদ্ধটি ছিল গ্রিকদের বিরুদ্ধে। এভাবেই
অটোমান বংশের সাথে রাজশক্তির বৈধ সম্পর্ক স্থাপিত হয়। পরবর্তীতে
সুলতান স্বয়ং আর্তঘরুলের পুত্রসন্তান ওসমানকে সার্বভৌমত্্রে চিহ্ন প্রদান
করেন, বাদ্য আর ব্যানারের আদলে ।
এছাড়া আরো কিছু কল্পকথা প্রচলিত আছে এ ক্ষেত্রে। যেমন__আর্তঘরুল
ও তার সন্তান ওসমানের স্বপ্নু। বলা হয়ে থাকে যে, ওসমান এক রাত্রে একজন
ধর্মপ্রাণ মুসলিমের বাড়িতে রাত কাটান। নিদ্রার পূর্বে এই ধর্মপ্রাণ ব্যক্তি
ওসমানকে একটি বই দিয়ে যায়। বইয়ের ওপরে নাম পড়তে গিয়ে ওসমান
প্রতিউস্তর পান যে, “এটি কোরআন।
ঈশ্বরের বাণী, যা তিনি তার নবী
মোহাম্মদের মাধ্যমে পৃথিবীতে প্রকাশ করেছেন।” ওসমান পুস্তক পাঠ শুরু করেন
এবং সারা রাত্রি দীড়িয়ে থেকে পাঠ করে যান। ভোর বেলা এসে তিনি ঘুমিয়ে
পড়েন। মুসলমানদের মতে যেটি নবীকে স্বপ্নে দেখার আসল সময়। ঘুমের
মাঝে একজন দেবদূত আসেন ওসমানের কাছে । আর উচ্চারিত হয় এই বাণী
এবং তাদেরও সন্তানেরা যুগযুগান্তর ধরে সম্মানপ্রাপ্ত হবে।”
পরবর্তী স্বপ্নে আছে এক নারী। যার নাম মালকাতুম, যিনি শীঘ্বই
ওসমানের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হবার কথা । মালকাতৃম পাশ্ববর্তী এক
গ্রামের বিচারকের কন্যা । বিচারকের নাম শেখ ইদেব আলী । দুই বছর যাবৎ
বিবাহে দ্বিমত পোষণ করে আসছেন । এর পরে ওসমান আরেকটি স্বপ্ন দেখতে
পান। স্বপ্নে ওসমানের পাশে ঘুমন্ত শেখের বুক চিরে চাদ ওঠে, যেটি তার
সমগ্র বুক ঢেকে ফেলে ।
তারপর ওসমানের কোমর থেকে জন্ম নেয় এক বৃক্ষ ।
যেটি এক পর্যায়ে সমগ্র বিশ্ব ঢেকে ফেলে এর সুন্দর সবুজ শাখা-প্রশংসা
দিয়ে। এর নিচে ওসমান দেখতে পান চারটি পবর্তমালা__ককেশাস, মানচিত্র,
বৃক্ষ রাশি এবং বলকান অঞ্চল। এর শিকড় থেকে উৎপন্ন হয়েছে চারটি নদী ।
তাইঘ্িস, ইউফ্রেতিস, নীল এবং দানিযুব।
শস্যভরা মাঠের পর মাঠ, জঙ্গলে
পূর্ণ পাহাড় । উপত্যকার ওপর শহরজুড়ে পিরামিড, সুউচ্চ টাওয়ার, সমাধি
সৌধ ঢেকে আছে অর্ধচন্দ্র দিয়ে। সুগন্ধযুক্ত শাখা প্রশাখায় বসে নাইটিঙ্গেল
আর উজ্জ্বল রঙের তোতা পাখি ।
এই গাছের পাতা রূপ নেয় তরবারির ফলায়। বাতাস এসে কনস্টান্টিনপোলের
দিকে নির্দেশ করে; যেটি অবস্থিত দুটি সমগ্র ও দুটি মহাদেশের মাঝখানে,
মনে হয় যেন দুটি ম্যাপায়ার ও দুটি এমেরান্ডের মাঝখানে হীরার পর্বত আর
এভাবেই পরিণত হয় একটি মূল্যবান আংটির পাথরে, যা ঘিরে আছে পুরো
পৃথিবী। ওসমান আংটিটি তার হাতে পরতে যান আর ঠিক সেই সময়ে ঘুম
ভেঙে যায়।
তিনি ইদেব আলীর কাছে স্বপ্নের ব্যাখ্যা পান ঈশ্বরের ইচ্ছা
হিসেবে । ফলস্বরূপ ইদেব আলী নিজের কন্যার সাথে ওসমানের বিয়ে দিতে
রাজি হয়ে যান। অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয় সত্যিকারের বিশ্বাস আর কঠিন প্রথার
সাথে একজন দরবেশের মাধ্যমে । যার জন্য ওসমান পরবর্তীতে একটি
প্রার্থনার স্থান নির্মাণ করেন ।
এই দুই কাহিনীর মাধ্যমে এটি স্পষ্ট বোঝা যায় যে ওসমান ও তার
লোকেরা বসতি স্থাপনের প্রথম দিকেই মুসলিম ছিলেন না। একাদশ
শতাব্দীর পর থেকে এশিয়া মাইনরে আগত তুর্কিরা আরব সমাজের সাথে
তাদের পূর্ব সম্পর্কের কারণে মুসলিম ধর্মে রূপান্তরিত হয়েছিল কিন্ত
ত্রয়োদশ শতাব্দীতে এসে যে দ্বিতীয় প্রবাহ শুরু হয় তাদের বেশির ভাগ
ছিল পৌত্তলিক-।
আর ধারণা করা হয় অটোমান-রাও এদের অনুসারী ছিল।
এদের বেশির ভাগই ছিল শরণার্থী, যারা মঙ্গোল পৌত্তলিকদের দ্বারা
আক্রান্ত হয়েছিল। এদের মাঝে অনেকেই পূর্বাঞ্চলে রয়ে গিয়েছিল এবং
সম্ভবত মঙ্গোলরা চলে যাবার পরে নিজেদের অঞ্চলে ফেরত চলে
গিয়েছিল । কিন্তু বেশির ভাগই ছিল যুদ্ধ মনোভাবাপন্ন, যারা সেলজুকদের
ওমিতে গিয়ে হামলা করে ।
এদের মাঝেই ছিল অটোমানরা, যারা পরবর্তীতে সুলতান আলা-এদ-
দিনের অনুগহ লাভ করেছিল। সুলতান অটোমানদের নিজের সেনাবাহিনীতে
ভাড়াটে সৈনিক হিসেবে না রেখে বরঞ্চ সীমান্তবর্তী বিবদমান অঞ্চলে পাঠিয়ে
দেন। সেখানে অটোমানদের কাজ ছিল আঞ্চলিক শান্তি বজায় রাখা অথবা
শইজেন্টাইন গ্রিকদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তাদের নব্য প্রাপ্ত ক্ষমতা ব্যবহার
করা । আর এখানেই সবচেয়ে সম্ভাবনা বেশি বলা যায় যখন আর্তঘরুল এবং
ওসমান ইসলাম গ্রহণ করেন।
আর এভাবেই অটোমান জাতি উদ্দীপিত হয়ে
ওঠে । যাদের মাঝে একাধারে ছিল যাযাবরদের চারিত্রিক গুণাবলি আর
তুর্কিমানদের মতো পদাতিক যোদ্ধার বৈশিষ্ট্য আর জয়ীর প্রতি সামরিক
সম্মাননা দেয়া, অবিশ্বাসী খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ইত্যাদি ।